
সিক্স ডিগ্রি সেপারেশন: আমরা পরস্পরের কতটুকু কাছাকাছি
বিশাল পৃথিবীতে আমি বড়োই একা
বিশ্বাস করুন কিংবা না-ই করুন, প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোনো না কোনো সময়ে এমন অনূভুতির উদয় ঘটেছে। হোক সেটা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়। অনেকেই মনের ভেতর জমে থাকা অবহেলাজনিত অভিমান প্রকাশ করতে উচ্চারণ করেছেন এই বাক্যটি, আবার অনেকে একে ব্যবহার করেছেন একাকিত্ব আর শূন্যতার প্রতীক হিসেবে।
সাতশো কোটি মানুষের ভিড়ে নিজেদের বড্ড একা বলে মনে হলেও, গণিত আর বিজ্ঞানের ভাষ্যটা এখানে একদমই ভিন্ন। গাণিতিক হিসেব বলছে, আপনার যদি ৫০ জন মানুষ চেনাজানা থাকে, তবে আপনি মোট ১৫.৬২ বিলিয়ন মানুষের সাথে যুক্ত থাকতে পারেন!
বিচিত্র এই ধারণার নাম সিক্স ডিগ্রি সেপারেশন।
সিক্স ডিগ্রি সেপারেশন
সিক্স ডিগ্রি সেপারেশন কী, সেটি জানতে হলে আগে বুঝতে হবে, সম্পর্কের ব্যবধান বলতে আসলে কী বোঝায়। যিনি এই মূহুর্তে লেখাটি পড়ছেন, তার উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যাক।
আপনি আপনার বাবা-মা-ভাই-বােন-বন্ধুদের চেনেন। ধরা যাক, এই মানুষগুলোর মধ্যে একজন হলো “X”, যে কি না আপনার বন্ধু। তাহলে এই X ব্যক্তিটির সাথে আপনার সম্পর্কের ব্যবধান হবে এক ডিগ্রি।
এখন এই X বন্ধুর একটি ছােটভাই আছে “Y” নামে, যাকে আপনি চেনেন না। এক্ষেত্রে Y এর সাথে আপনার সম্পর্কের ব্যবধান হবে দুই ডিগ্রি।
আবার ধরি, “Y” এর একজন বন্ধু আছে “Z” নামে, যাকে আপনি কিংবা আপনার বন্ধু X কেউই চেনেন না। সেক্ষেত্রে Z এর সঙ্গে X এর সম্পর্কের ব্যবধান হবে দুই ডিগ্রি। আর আপনার সাথে Z এর ব্যবধান হবে তিন ডিগ্রি ।
পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা অগণিত। তাই এই ধারা যত এগোতে থাকবে, অচেনা বা অদেখার মাত্রা অনুযায়ী ব্যবধানের ডিগ্রি ততই বাড়তে থাকার কথা।
কিন্তু এ তত্ত্বের মূলকথা হলো, যদি পৃথিবীর সকল মানুষকে হিসেবে ধরে ব্যবধানের ডিগ্রি যােগ করা হয়, তবে দেখা যাবে এর গড় ছয় কিংবা তারও কম।
এর সহজ অর্থটা হলো, পৃথিবীর যেকোনো মানুষের সাথে আপনার সম্পর্কের ব্যবধান ছয়ের মতো। তার কাছে পৌঁছতে মাত্র ছয়জনের বেশি মানুষের দরকার পড়বে না আপনার।
বিশ্বাস হচ্ছে না?
ভেবে দেখুন, আপনি কখনো সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছেন কি না। যদি দেখে থাকেন, তবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার ব্যবধান এক ডিগ্রি। আর যেহেতু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন, সে হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আপনার ব্যবধান হবে দুই ডিগ্রি।
যদি ধরে নিই, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আপনি স্বচক্ষে দেখেননি, তবে আপনার পরিচিতদের মধ্যে এমন কেউ নিশ্চয়ই আছেন যিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছেন। সেক্ষেত্রে দূরত্ব এক ডিগ্রি বেড়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনার ব্যবধান হবে দুই ডিগ্রি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন ডিগ্রি।
এখানেই শেষ হচ্ছে না। একবার ভেবে দেখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিশ্বের কত বিখ্যাত বিখ্যাত লােককে দেখেছেন। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, সেসব বিখ্যাত লােকের সাথে আপনার সর্বোচ্চ ব্যবধান হবে মাত্র তিন থেকে চার ডিগ্রি!
এবার বলুন, পৃথিবীর সকল মানুষের সাথে মাত্র ছয় ডিগ্রীর ব্যবধান থাকবার ব্যাপারটি কী মোটেও অবাস্তব লাগছে?
যেভাবে এলো ধারণাটি
সিক্স ডিগ্রি সেপারেশন তত্ত্বের মধ্যে বিজ্ঞান এবং গণিতের এক অভূতপূর্ব মিশেল দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন, এই তত্ত্বটি হয়তো কোনো বিজ্ঞানী বা গণিতবিদের মাথা থেকে বেরিয়েছে। তবে তাদের একটু হতাশই হতে হবে বৈকি। কেননা এই ধারণাটি সর্বপ্রথম যার মাথা থেকে আসে, তিনি বিজ্ঞান বা গণিতের জগতের কেউ নন, তিনি হলেন ফ্রিগয়েস করিন্থি, পেশায় একজন লেখক।
এই হাঙ্গেরিয়ান লেখক ১৯২৯ সালে Everything is Different নামে একটি বই লেখেন। এটি ছিলো ছোটগল্পের একটি সংকলন। এই সংকলনের একটি গল্প Chains এ তিনি বলেন,
“… আমাদের মধ্যে একজন প্রস্তাব করলো, পৃথিবী ক্রমশ ছেট হয়ে আসছে। এতটাই ছোট যে পৃথিবীর দেড় বিলিয়ন মানুষের মধ্যে যে কারো সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করতে পাঁচজনের বেশি মানুষের দরকার পড়বে না…”
মূলত এভাবেই সিক্স ডিগ্রি সেপারেশনের ধারণাটি সবার মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠে।
স্ট্যানলি মিলিগ্রামের পরীক্ষা
অনেকেই হয়তো ভাবছেন, মুখে তত্ত্ব জাহির করে বেড়ানো অনেক সহজ, প্রমাণ করে দেখানোটাই আসল। তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে হয়, সিক্স ডিগ্রী সেপারেশন ধারণাটির সমর্থনে পরিচালিত হয়েছে নানা গবেষণামূলক পরীক্ষা। “স্মল-ওয়ার্ল্ড প্রবলেম” এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
১৯৬৭ সালে মনােবিজ্ঞানী স্ট্যানলি মিলিগ্রাম একটি এক্সপেরিমেন্ট পরিচালনা করলেন। তিনি তার পরীক্ষার নাম দিলেন স্মল-ওয়ার্ল্ড প্রবলেম।

এই এক্সপেরিমেন্টের অংশ হিসেবে দৈবচয়নের ভিত্তিতে বোস্টন এবং নেব্রাস্কা শহরের তিনশো মানুষকে বেছে নেয়া হয়। মিলিগ্রাম তাদের প্রত্যেকের কাছে একটি প্যাকেট পার্সেল করে পাঠান, যার ওপরে বোস্টনের একজন স্টকব্রোকারের ঠিকানা লেখা ছিল।
মিলিগ্রাম নির্দেশনা দিলেন, নিজে কিংবা পরিচিত মানুষদের মাধ্যমে প্যাকেটটি স্টকব্রোকারের কাছে পৌঁছে দিতে। অর্থাৎ, তারা যদি সেটি নিজে পৌঁছাতে না পারে, তবে যেন এমন একজন ব্যক্তিকে পাঠায়, যে সেটি পৌঁছে দিতে পারবে। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি নিজে প্যাকেটটি পৌঁছাতে না পারে, তবে সে যেন তৃতীয় ব্যক্তির কাছে দেয়, যে কি না ওই প্যাকেটটি উদ্দীষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছাতে পারবে। এভাবে ততক্ষণ পর্যন্ত হাত-বদল চলতে থাকবে, যতক্ষণ না প্যাকেটটি তার গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে।
তবে মিলিগ্রাম এর সাথে একটি শর্ত জুড়ে দিলেন। তা হলো- হাত বদল হওয়া প্রতিটি মানুষের নাম এই প্যাকেটের ওপর লিখে দিতে হবে। এই শর্তের উদ্দেশ্য ছিলো প্যাকেটটি স্টকব্রোকারের হাতে পৌঁছাবার আগপর্যন্ত মোট কতজনের হাত-বদল হয়ে আসে, সেটি পর্যবেক্ষণ করা।
দেখা গেলো, মাত্র ৬৪টি প্যাকেট তার উদ্দীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছেছে।
মিলিগ্রাম ভেবেছিলেন, যেহেতু স্টকব্রোকারকে বাছাইকৃত তিনশ জনের কেউই চিনতো না, তাই প্রতিটি প্যাকেটের ওপরে হাজার হাজার মানুষের নাম লেখা থাকাটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু প্যাকেটগুলো সংগ্রহ করার পর তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, যে প্যাকেটগুলো স্টকব্রোকারের হাতে পৌঁছেছে, সেগুলোর প্রতিটি গড়ে মাত্র ৫.২ জন মানুষের হাত বদল হয়েছে।
যদিও মিলিগ্রামের নমুনা নির্বাচন এবং প্যাকেটগুলো সঠিকভাবে পৌঁছানোর অপর্যাপ্ত হার নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তবুও পৃথিবীর মানুষগুলাে একে অন্যের কতটা কাছাকাছি হয়ে এসেছে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পরীক্ষাটি যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
সিক্স ডিগ্রি সেপারেশন ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
২০১১ সালে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের চার শিক্ষার্থী কর্তৃক ১৫০০ টুইটার ব্যবহারকারীর মধ্যে সম্পর্কের ব্যবধান নিয়ে গবেষণা চালায়। তাতে দেখা যায়, প্রত্যেক ব্যবহারকারীর মধ্যে গড়ে পারস্পরিক ব্যবধান মাত্র ৩.৪ থেকে ৩.৮ ডিগ্রি।
একই বছর মিলান ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ফেসবুকের এক গবেষণায় উঠে আসে, ৭২১ মিলিয়ন ফেসবুক অ্যাকাউন্টের যেকোনো দুটির মধ্যে গড় দূরত্ব মাত্র ৪.৭৪ ডিগ্রি।
এর পাঁচ বছর পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেসবুক আবার জানায়, সর্বমোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে ১.৬ বিলিয়নে এসে ঠেকলেও, তাদের মধ্যে দূরত্বের ব্যবধান নেমে এসেছে ৩.৫৭ ডিগ্রিতে।
তাই বলা যায়, ১৯৬০ সালে মার্শাল ম্যাকলুহান যে “বিশ্বগ্রাম” এর স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আজ কল্পনা নয়, বাস্তব।
মানব মনস্তত্ত্ব নিয়ে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) শিশুশিক্ষা ও শিশুর মনস্তত্ত্ব
২) জ্ঞানের মনস্তত্ত্ব
৩) সামাজিক চেতনার মনস্তত্ত্ব
Writer: Usamah Ibn Mizan
Leave a reply